চন্দনা সেনগুপ্ত

মাল্লু একদিন দুপুর বেলায় খেলার ঘরে নিজের ডাইনোসরদের নিয়ে একা একা খেলায় মেতে আছে। কখনও তারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে, কখনও খাবার খুঁজে খুঁজে বেড়ায়। মা কয়েকদিন আগে মাল্লুকে একটা বই পড়ে শুনিয়েছেন কেমন করে মহা প্রলয়ে তারা সব পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে গেছে। সে কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমে তার চোখটা জুড়ে এল। এই সময় বিছানায় শোয়ার কথা সে ভাবতে পারে না। ঘুমোলেই তো খেলার সময়টা কমে যাবে। কিন্তু খুব ভোর থেকে উঠে সে বাবার সঙ্গে মাঠে ছুটতে গিয়েছিল, তাই এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। একটা ব্যাঙ আর সাপকে ডাইনোসরের মাথায় উঠিয়ে নাচাতে নাচাতে হাতটা স্থির হয়ে গেল তার। মনে হল সেই বহু যুগ আগের ঐ মহা বিশাল জানোয়ারদের কাছে পৌঁছে গেছে সে। চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে কত স্টেগোসরাস, একজন মাল্লুকে বললে, –

– “এস গলাটা ধরে আমার পিঠে বসো, আমি তোমাকে থান্ডার মনস্টার-এর গল্প বলব”।

মাল্লু জানতে চাইলে, – “কোথায় থাকে সে? আমাকে দেখাতে পারো?”

– “ঐ মেঘেদের পিছনে ওর বাড়ি। ভীষণ শক্তিশালী, মাঝে মাঝে চোখ রাঙায় আর ভীষণ গর্জন করে, শুনে বড় ভয় করে আমার, পৃথিবীটা যেন কাঁপতে থাকে।”

মাল্লু ভীষণ অবাক হল, – “তুমি এত শক্তিশালী সে তোমার চেয়েও বড়?”

– ‘ওরে বাবা সেতো একা নয়, কত শত তার সৈন্য আর বিদ্যুৎ নামে তার এক এমন অস্ত্র আছে তা একবার কারো ঘাড়ে পড়লে সব ধ্বংস হয়ে যাবে।’ দুজনে মিলে চললো পাহাড়ের দিকে। ওকে বজ্র দানবও বলে। সেখানে একটা বিরাট বড় বাজ পাখি ডাইনোসরের পিঠ থেকে মাল্লুকে নিয়ে বসালো নিজের ডানার ওপরে। – “ও তো কবে চলে গেছে পৃথিবী থেকে। ওটা ডাইনোসরের ‘ঘোস্ট’ মানে ভূত ছিল। তুমি ওদের নিয়ে খেলতে ভালোবাসো। তাই তোমায় এখানে পৌঁছে দিল। চলো আমি এবার তোমায় পাহাড়ের ওপর থেকে মেঘেদের সঙ্গে কথা বলাবো। ওখানেই ‘থান্ডার মনস্টার’ থাকে। ওকে তো এদেশে বজ্র দানব বলে।”

মাল্লু উড়ে উড়ে চললো তার সঙ্গে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল ঘন কালো মেঘের দল যেন শত শত ড্রাম বাজাচ্ছে কেউ, বাজ পাখিটা মাল্লুকে নিয়ে লুকালো একটা বিরাট বড় বট গাছে। আসে পাশের তাল, নারকেল গাছগুলোও দুলছে ভীষণ জোরে।

 

এবার হাওয়ার দৈত্য নেমে আসছে। বজ্র দানবও তান্ডব শুরু করলো। ভয়ে তো মাল্লুর বুক কাঁপছে। ওদিকে বিদ্যুতের ঝলক চমকে দিচ্ছে, ঝলসে দিচ্ছে চোখ দুটো। কড় কড় কড়াৎ শব্দে বাজ পড়ল অর্থাৎ বিদ্যুতের আগুন পড়ে একটা মস্ত লম্বা তাল গাছ একেবারে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল।

মাল্লুর খুব রাগ হল ঐ থান্ডার মন্সটারটার ওপরে।

মেঘের মধ্যে থেকে কটমটিয়ে তারদিকে তাকালো ঐ ‘বজ্র দানব’, তারপর গম্ভীর ভীষণ কর্কশ গলায় বললে, – “আমার ওপরে তুমি রাগ করছো জানি, আমি মানুষদের ওপরে ভীষণ বিরক্ত হয়েছি। গাছ কেটে কেটে তারা পৃথিবীর কি হাল করেছে দেখেছো? আগে এখানে কত জঙ্গল ছিল, জঙ্গল দৈত্যরা, শুকনো পাতা ফুল খেয়ে, ঝর্ণার জল পান করে শান্তিতে থাকতো, এখন সব শেষ।”

মাল্লু বললে – “কিন্তু তুমিও এত ধংসাত্বক ভাবে আসছো, ধ্বংস করে দিচ্ছ কত গ্রাম।” – না এর পরেই আমি বৃষ্টি রানীকে পাঠাব, সে পৃথিবীতে আবার শীতলতা, স্নিগ্ধতা নিয়ে আসবে। বৃষ্টি থামতেই বাজ পাখিটা মাল্লুকে পিঠে চাপিয়ে একটা মাঠে নামিয়ে দিল। সেখানে লোকেরা মাটি কেটে কেটে গর্ত বানিয়ে রেখেছে। আসে পাশে গাছপালাও নেই। মাল্লু হঠাৎ মাটির ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো। গভীর খাদে ক্রমশ সে সেঁধিয়ে যেতে থাকল। পাশে পাশে ইঁদুরের গর্ত, নেউল, সাপ সবাই অবাক। “তুমি এখানে কোথায় যাচ্ছো?” – একটা আর্থ ওয়ার্ম খুব মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করল।

– “মাটির ভিতরে কোন Earth Monster – মিট্টি দানব থাকে – মাটি কাঁপায়, ভূমিকম্প আনে তাকে দেখতে যাচ্ছি।” বললো মাল্লু। ওর কথা শুনতে পেয়ে সত্যি সত্যিই একটা মাটির ভেতরকার দানব যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। গমগমে গলায় বললো – “কে রে কে? আমার রাজ্যে? কে এমন করে চলে আসছে? দম বন্ধ হয়ে যাবে তোমার।”

মাল্লু বললে – “ইচ্ছে করে এসেছি নাকি? বজ্র দানব, হাওয়া দানব, অরণ্য দানবের পর তোমার খোঁজ করতেই ওরাই তো এমন ধাক্কা দিল যে – আমি গর্তে পড়ে গেলাম।” – এখন বেরুবার উপায় খুঁজতেই ঐ মাটির দানব এবার তাকে নিয়ে গেল, লাভা দৈত্যের (Lava Monster) এর কাছে।

মাল্লুর গায়ে ভালো করে মিট্টি লেপে দিয়েছিল ঐ মিট্টি দানব, তাই গলিত গরম ঐ লাভা মনস্টার কোনো ক্ষতি করতে পারলো না মাল্লুর। এরপর তাকে ভীষণ জোরে ঠেলা দিয়ে একটা বিরাট আগ্নেয়গিরি মুখ থেকে খুব জোরে বাইরে বার করল ঐ লাভা দৈত্যটা।

মাটিতে পড়ে মাল্লু যেন নিশ্বাস ছেড়ে বাঁচল। ঐ লাভার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছিল সে কিছুটা, হঠাৎ সাদা ছাই এসে ঢেকে দিল তার শরীর।

মাল্লুর মনে হল সে ছাই মনস্টার হয়ে গেছে। সাদা ভস্ম মাখা ছোট্ট দেহটা দেখে আকাশের একখণ্ড সাদা মেঘের খুব দয়া হল, সে তখন নিচু হয়ে মাল্লুকে তার ভেলায় তুলে নিয়ে ভাসতে ভাসতে চলল সেই সুদূর আলাস্কার দিকে। উত্তর মেরুর প্রায় কাছাকাছি এসে মাল্লু দেখা পেল স্নো মনস্টারের। সেও ধবধবে সাদা, বরফের ওপরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাল্লু বললে, এত ঠান্ডায় তুমি কি করে থাক? খুব নরম সুরে সে বললে, – “আমার ঠান্ডা লাগে না, একটুও গরম তাপ সহ্য করতেই পারি না। তাহলেই গলে যাবো যে।”

– “কি খাও তুমি?” – মাল্লুর প্রশ্ন। “পোলার বেয়ার? রেন ডিয়ার? সিলভার ফক্স?”

না না শুধু স্নো খাই। তাই তো আমার নাম তুষার দানব। গ্লোবাল ওয়ার্মিং বলে একটা কথা শুনেছ তোমরা? বিশ্ব উষ্ণায়ন? নির্বোধ মানুষ এত অরণ্য, জঙ্গল মানে গাছপালা কেটে ফেলেছে যে সারা বিশ্ব – এ তোমাদের সবুজ ধরণী গরমের তাপে পুড়ে যাচ্ছে। গাছের ছায়া নেই, বৃষ্টি নেই তাই ধীরে ধীরে আমার শরীরও তো গলে যাচ্ছে। আমি যদি আরও সব গ্লেসিয়ার, আইসবার্গদের নিয়ে সাগরে পড়ি তাহলে ভীষণ বন্যায় ডুবে যাবে এই সুন্দর পৃথিবীটা। মাল্লু তুমি যাও, বোঝাও সবাইকে। বরফ জমা পাহাড়েরা ভয় পাচ্ছে আজ।”

এবার মাল্লু দেখলে এটা তার একার দ্বারা সম্ভব হবে না। মাল্লু চিৎকার করে সবাই কে সাবধান করতে করতে ছুটল বাড়ির দিকে, – ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।

Leave a comment